ডা. মাহমুদুল কবির:
বাংলাদেশে করোনা চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথদের চিকিৎসা করার অনুমতি মিলেছে এবং তা দেখে হোমিওপ্যাথগণ অত্যন্ত উল্লাসিত। কিন্তু আমি সেই উল্লাসটি অনুভব করতে পারছি না। এবং করতে না পারার কারণটি হচ্ছে, মনের মাঝে থাকা একটি সন্দেহ ও ক্ষোভের অনুভূতি। যেখানে পাশের দেশ ইন্ডিয়া, বর্তমান সময়ের হোমিওপ্যাথির কর্ণধার হওয়া সত্ত্বেও, কেঁদে-কেটে অনুমতি পেলো না- সেখানে আমাদের দেশে প্রায় না চাইতেই অনুমতি কিছুটা সন্দেহের উদ্রেক করে বৈকি। কিন্তু মনে প্রাণে প্রার্থনা করছিলাম, আমার এই কু-ধারণা যেন মিথ্যা হয়, কিন্তু হয়নি। সেই সন্দেহই অবশেষে বাস্তবতার রূপ নিয়েছে- পরবর্তীতে এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের অসীম নিরবতার চেহারায়।
গত ২৩ মার্চ অপ্রত্যাশিতভাবেই দেখতে পেলাম, হোমিওপ্যাথগণ করোনা সংক্রমণের চিকিৎসা করতে পারবে। কিভাবে করতে পারবে? বাংলাদেশে কয়টা হোমিওপ্যাথিক হাসপাতাল আছে? ও আচ্ছা! আপনারা বলবেন, প্রতিটি হোমিওপ্যাথিক কলেজের সাথেই তো একটা করে হাসপাতাল। তাহলে বলতেই হচ্ছে- এটি হচ্ছে এদেশের প্রাচীনতম প্রহসনের একটি। সেখানে কি পরিমাণ চিকিৎসা হয়- সেটা আমরা খুব ভালোমতোই জানি। বলা হয়েছে, সেটা একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত খোলা থাকে। আর যদি কোনটা খোলা থাকেও, তবে সেখানে চিকিৎসার বন্দোবস্ত ও নিরাপত্তার জন্য কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে?
একটা ঘোষণা জনসমক্ষে প্রকাশ করে বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক বোর্ড এমনভাবে হাওয়া হয়ে আছে যে, বাংলাদেশে এর অস্তিত্ব আছে কিনা সেটা বোঝাটাই এখন মুশকিল। কেন? সেখানে সবাই তো হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক। এবার কি জাতির দুর্যোগে, এবং হোমিওপ্যাথির বিজয়ের (!) সম্ভাবনা-প্রাক্কালে তাদের সবার আগে থাকার কথা ছিলো না! বহুমুখী উদ্যোগের পুরোভাগে, বরাবরের মতো তাদের ছবিগুলো দেখতে পাওয়ার কথা ছিলো না! নাকি তারাও PPE সঙ্কটে ভুগছেন?
সারা বছর ধরে সেমিনারের পর সেমিনার, আলোচনা সভা, বক্তৃতা-বক্তব্য, আন্দোলন ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকা, ক্ষেত্র বিশেষে ব্যবসা করা হোমিওপ্যাথিক সংগঠনগুলোকে এখন এরকম ঝিমধরা নিমগাছের মতো লাগছে কেন? তাদের মাথায় কি এ চিন্তাগুলো আসে না? নাকি আমিই ভুল দেখছি?

দুম করে জনগণকে হোমিওপ্যাথদের কাছে চিকিৎসা করতে বলে দেয়া হলো। আর তারপর থেকে বোঝাটাই কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, এখন হোমিওপ্যাথদের এই বিশাল দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ কে? তাদের দেখভাল কে করবে? প্রয়োজন, সুবিধা-অসুবিধা কোথায় জানাতে হবে! বাস্তব ও সক্রিয় কোন অস্তিত্বের ঠিক-ঠিকানা দিতে পারবেন? এদিকে আমাদের অতি-আগ্রহী বহু হোমিওপ্যাথও ঝাঁপিয়ে পড়েছেন- করোনা আক্রান্তের চিকিৎসা করবেন বলে। কিন্তু চিকিৎসা কাঠামোরই যেখানে কোন খোঁজ নেই, কর্তৃপক্ষের কোন নিশানা নেই- আজকে জানবাজি রেখে করা করোনার চিকিৎসাগুলো যে কালকে সর্দির চিকিৎসা বলে স্বীকৃত হবে- সেটা কি তারা একবারও ভেবে দেখেছেন? হ্যা, পরার্থপরতা ও মানবতার বুলি তুলে হয়তো বলবেন- ‘যা হয় হোক, দুনিয়াবী লাভের জন্য কিছু করছি না, মানবতার জন্য করবো’। ভালো কথা। কিন্তু হোমিওপ্যাথিকে উন্নয়নের যে সুযোগটি আপনি পেয়েছেলেন এবং তা যে আপনি নষ্ট হতে দিলেন- সেই দায় কে নেবে?
হাসপাতালে দায়িত্বরত চিকিৎসক, নার্সগণ যদি নিরাপত্তার উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ না করতে পারেন- তবে সেটা যে কেবল তাদেরই ক্ষতি, ব্যাপারটা তো এরকমও নয়। সেই হাসপাতালগুলো থেকে তো দিকে দিকে আরো সংক্রমণ ছড়াবে। কিন্তু সবাই এ ব্যাপারে নিশ্চুপ কেন? নাকি আপনারা ধরেই নিয়েছেন, অনুমতি দিয়েছে দিক- চিকিৎসা কে করতে যাচ্ছে!
না, আমি তাদের পক্ষে পিপিই-এর আবেদন করে বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক কর্তৃপক্ষ ও সরকারকে বিপদে ফেলতে চাই না। আর হোমিওপ্যাথরা সেটা চাইলে – তা নিয়ে যে বহু রসালো সমালোচনার সূচনা হবে, সেটা আমি জানি। ইতোমধ্যে দাবী উচ্চারণের আগেই সুভাষ সিংহ রায় ভীষণ শঙ্কিত। তিনি অতি-বিনয়ের সাথেই (!) সেই তাচ্ছিল্যের কাজটি শুরু করেছেন। কেন! হোমিওপ্যাথগণ চিকিৎসা যদি করেন, তাহলে তাদের নিরাপত্তার প্রয়োজন নেই বুঝি? অধিকাংশ মানুষেরই (এমনকি আমাদের হোমিওপ্যাথদেরও অনেকের) ধারণাই নেই, বাজারে পাওয়া পিপিইগুলো ভাইরাস-প্রটেক্টিভ নয়, ওগুলো একপ্রকারের আত্মসান্ত্বনা বা আত্মপ্রতারণা বলা যেতে পারে। কাজেই, নিরাপত্তার প্রয়োজনে হোমিওপ্যাথগণের ভাইরাস-প্রটেক্টিভ পিপিই দাবী করাই কি সঙ্গত ছিলো না?
কিন্তু চিরকালীন বঞ্চিত ও সেক্রিফাইজ করা হোমিওপ্যাথগণ যদি তাদের সেই দুশ্চিন্তাকে লাঘব করে, নিজ অর্থেই কিনে নিতে চান, তাহলে কোথায় পাওয়া যাবে, তা কি নিশ্চিত করা হয়েছে? এখন তো বাজারে এই ভুয়া পিপিই-এর মূল্যই ব্যবসায়ীরা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়ে আখের গুছিয়ে নিচ্ছে। সত্যিকারের পিপিই ন্যায্যমূল্যে যেন পেতে পারে- তা বন্দোবস্ত করার হোমিওপ্যাথগণ কার নিকট জানাবেন?
কেবল তাই-ই নয়। হোমিওপ্যাথদের অনুমতি যেহেতু দেয়া হয়েছে। তাহলে টেস্টিং কিটসও কি সেখানে প্রয়োজন ছিলো না! সরকার হয়তো এই গন্ডগোলের তালে-গোলে হোমিওপ্যাথদের একটা কিটস দেবার কথা ভুলে গিয়েছেন, কিন্তু হোমিওপ্যাথির হর্তাকর্তাদের কারো গলা থেকে, কিংবা আমাদের কলেজগুলোর কোনটার তরফ থেকে এ সম্বন্ধে কি একটা আওয়াজও কেউ শুনতে পেয়েছেন? এটা কি সাধারণ জ্ঞান নয় যে, একটা টেস্টও করা হয়নি, এবং একটা পজিটিভ করোনাকে আরোগ্য করে দেখাননি মানেই হচ্ছে- আপনি একজন করোনার রোগীকেও চিকিৎসা করেননি। নাকি ছাগলে তিন নমবর বাচ্চার মতোই বর্তমান সমাজ ও প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থার কাছে এর চেয়ে বেশি উদারতা আপনি আশা করে বসে আছেন!
করার মতো কাজ বহু ছিলো। এই বিশাল জনসংখ্যার চিকিৎসা করতে গেলে, বেশ কিছু প্রকারের ঔষধ লাগতে পারে- যার কিছু কিছু হয়তো এদেশে এখন পাওয়াই যাবে না। তৈরি করা বা আমদানি করা যেতে পারে কভিড-১৯ নোসোড। ভালো মানের ঔষধের মজুদ ঠিক আছে কিনা- প্রয়োজন ছিলো সেটা খতিয়ে দেখার। কারণ, রোগটি মারাত্মকভাবে প্রাণহানিকর এবং এই রোগটিতে আক্রান্তের ক্ষেত্রে নিম্নমানের ঔষধ দেবার ঝুঁকিটি গ্রহণ করা কোনক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু কোথায় সে কাজের উদ্যোগ!
যদি বলেন, হাসপাতাল বা সংঘবদ্ধ উদ্যোগের পরোয়া না করে- ব্যক্তিগত উদ্যোগে হোমিওপ্যাথগণ চিকিৎসা করবেন। প্রশ্ন হচ্ছে, তা কেন করবেন? তাতে দেশের ও দশের কি উপকারটা হবে? একজন করোনা রোগী যদি ক্লিনিকে যায়- তার মাধ্যমে দশজন সেখানে আক্রান্ত হবেন। চিকিৎসক যত দক্ষই হোন- ক্রমবর্ধমান এই সংক্রামিত সংখ্যার কয়জনের চিকিৎসা তিনি করতে পারবেন। বাজারে যে পিপিইগুলো পাওয়া যাচ্ছে- তার একটাও ভাইরাস-প্রটেক্টেড না। আর সেগুলো ব্যবহার করার ট্রেইনিংটি পর্যন্ত অধিকাংশ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের নেই। সব-কয়জন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসককে গণহারে আক্রান্ত হবার মুখে ছেড়ে দিয়ে কর্তৃপক্ষ আসলে কোন উদারতাটি প্রকাশ করতে চাইছেন? হোমিওপ্যাথ ও হোমিওপ্যাথির উন্নয়নের পথ খোলা হয়েছে, নাকি ধ্বংসের?!!!
অনেকেই এদেশে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিপ্লব আনবেন বলে আকাশ-কুসুম স্বপ্ন দেখছেন এবং নাতি-দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখছেন। কিন্তু কিভাবে করবেন? দীর্ঘদিন ধরে, আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তি-ব্যবহারে সুবিধাবঞ্চিত হোমিওপ্যাথিক সমাজ কি আপনার প্রবন্ধ পড়েই দক্ষ হয়ে যাবে? এমনকি কিভাবে করোনার রোগীকে ক্লিনিক্যালি নিশ্চিতভাবে সনাক্ত করতে হবে- সে ব্যাপারটিতেও তারা কতটা সতর্ক, সেটা কি প্রশ্নসাপেক্ষ নয়? ঝামেলা চলে গেলে, এই সমস্ত বিপ্লবী রাতারাতি ‘সর্দির-ডাক্তার’ উপাধিতে ভূষিত হয়ে পড়বে না তো! প্রয়োজন কি ছিলো না- এই কাজগুলো যে চিকিৎসকগণ করতে পারবেন- তাদের তালিকা তৈরি করে, কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনায় সুশৃঙ্খলভাবে কাজ শুরু করার?
শুরু থেকেই আমার সন্দেহ ছিলো- হোমিওপ্যাথির উন্নতি বা তাদের সুযোগ দেবার চিন্তা মাথায় রেখে এই অনুমোদন দেয়া হয়েছে, নাকি এদেশের বিশাল সংখ্যক মানুষের চিকিৎসা-প্রয়োজনের দাবীর মুখে ‘ক্ষুধা লেগেছে? বাতাসা খাও’ – জাতের সুযোগ সৃষ্টি করে, হোমিওপ্যাথিকে সেই ক্ষুধার মুখে ‘বাতাসা’ বলে সম্মান দেয়া হয়েছে! আমি এখন উত্তরটা বোধহয় জানি। কারো অভিভাবক নেই মানা যায়, কিন্তু কিন্তু অভিভাবক সেজে বিশাল সংখ্যক এই জনগোষ্ঠীর সাথে এরকম একটি অভিনয় মঞ্চস্থ করে, প্রহসন করাটা মেনে নেয়া সত্যিকার অর্থেই বেদনাদায়ক।
আমার চিন্তা হয়তো বিপরীত স্রোতে বইছে বলে, অনেকে আমাকে গালাগালি শুরু করতে পারেন। কিন্তু আমিও একজন হোমিওপ্যাথ এবং হোমিওপ্যাথির উন্নতির আকাঙ্ক্ষা আমিও মনে প্রাণে চাইছি। কিন্তু সেটা যেন উন্নয়নে মুলো হয়ে নাকের সামনে ঝুলে না থাকে, এবং সেটার দিকে তাকিয়ে থেকে যেন সবাই মিলে গণহারে খাদে গিয়ে না পড়ি- আমি কেবল সেটাই নিশ্চিত হতে চাইছি। আমার অনুরোধ থাকবে, হোমিওপ্যাথগণ সচেতন হোন এবং নিজেদের ন্যূনতম অধিকারটুকু বুঝে নিয়ে, তারপর আত্মনিবেদিত হয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। যদি কেউ ভেবে থাকেন, কয়েকজন করোনার রোগীকে আরোগ্য করে- সুনাম অর্জন করবেন, ভুলে যান। যে অবস্থা চলছে, এরকম কোন কথা উচ্চারণ করলেওে ভবিষ্যতে আপনাকে লাঞ্ছিত হতে হবে- সুনাম অর্জন তো দূরের কথা। তাই আমি চাইছি, হোমিওপ্যাথদের করোনা চিকিৎসার করতে দেয়ার ঘটনাটি যেন স্রেফ একটা প্রহসন না হয়ে- সত্যিকার অর্থেই হোমিওপ্যাথির অনুমোদন হয় এবং এর আরোগ্যক্ষমতার স্বীকৃতি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
Discussion about this post