ডা. মাহমুদুল কবির:
কোন সন্দেহ নেই – বর্তমানের করোনা দুর্যোগে হোমিওপ্যাথগণ তাদের জীবন হাতে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। বহু কেইসে দুর্দান্ত সাফল্য হোমিওপ্যাথদের চমৎকৃত করছে। নিজেদের ক্ষুদ্র কমিউনিটিতে বহুজন বাহ্বা, করতালিতে মুখর হয়ে যাচ্ছেন, বিহ্বলিত হয়ে যাচ্ছেন। লিখে, ছাপিয়ে, ভিডিওতে কতভাবেই না কতটা হোমিওপ্যাথির, আর কতটা নিজেদের জাহির করে যাচ্ছেন সবাই। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আমার মনে হয়- এই চমৎকৃত হবার কাজটি বোধহয় হোমিওপ্যাথগণই একা একা উপভোগ করছেন। সাধারণ মানুষ কিংবা দেশের কর্তৃপক্ষের ক্ষমতায় থাকা বিশেষ মানুষগণের কার্যক্রম দেখে- তারা এতে কতটা প্রভাবিত হয়েছে তা অনুমান করলে সেটি কিন্তু নেতিবাচক ফলাফলই ইঙ্গিত করে। কিন্তু আমাদের হোমিওপ্যাথগণ তাদের ভীষণরকম আত্মরতিতে, তাদের চমৎকার নার্সিসিজমে এতটাই ব্যস্ত যে, সেটি চোখে পড়ার সময় বোধহয় তাদের নেই।
কেন এ কথা বলছি? কারণটি বোধহয়, কোন কিছুকে ভাসা ভাসা দেখাটা আমার অভ্যাসের মধ্যে নেই। চারদিকে এত সাফল্য! ক্যাম্পেইন, উদ্বোধন, ১০ টাকা টিকিটের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল, জনশূণ্য হোমিওপ্যাথিক আইসোলেশন সেন্টার, অনলাইন হটলাইন ট্রিটমেন্ট- কিন্তু ফলাফল কি? আছে কোন হিসাব-নিকাশ, সরকারি স্বীকৃতি?
অনেকেই বলতে পারেন, আমি স্বীকৃতির জন্যই বা এতটা কান্নাকাটি করছি কেন? উত্তরটা দিয়ে দিচ্ছি- সর্বত্র হোমিওপ্যাথির মাধ্যমে প্রচেষ্টা চলছে মানুষকে আরোগ্য করার। একজন হোমিওপ্যাথ হিসাবে এটি দেখতে পাওয়া অবশ্যই আমার জন্য গর্বের। কিন্তু তারচেয়ে বহু বেশি গর্বের হচ্ছে- হোমিওপ্যাথির সক্ষমতার প্রামাণ্য প্রতিষ্ঠা, এর প্রচেষ্টার সফল পূর্ণতা দেখতে পাওয়া- সেই সাথে অসংখ্য হোমিওপ্যাথদের এই আত্মনিবেদনের সার্থকতা প্রত্যক্ষ করা। আজকে যে হিসাব-নিকাশটিকে আমরা অবহেলা করছি- কালকে কিন্তু সেই হিসাব-নিকাশ দিয়েই আমাদের বিচার করা হবে, অবমূল্যায়ন করা হবে, ধ্বংস প্রচেষ্টা চালানো হবে।
হোমিওপ্যাথির যাত্রার শুরু থেকেই তৎকালীন এপোথেকারি ও তার চরম শক্তিশালী বর্তমান রূপ বিগ-ফার্মা, তাকে ধ্বংস প্রচেষ্টায় উন্মত্ত। এবার আমার মনে হচ্ছে- আমরা তাদের হাতে তাদের সেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর উপযুক্ত অস্ত্রটি তুলে দিয়েছি। আমার কথাকে প্রলাপ মনে হতে পারে কিন্তু বিগত দিনের কার্যধারায় আসুন বাস্তবতাটিকে একটু বিবেচনা করে দেখা যাক।
কভিড-১৯ আক্রমণের সূচনা থেকেই এদেশের হোমিওপ্যাথগণ চরম ঝুঁকিকে মেনে নিয়ে নির্ভয়ে পরীক্ষিত ও অপরীক্ষিত রোগীদেরকে চিকিৎসা দিতে শুরু করলেন। সরকারের বোধহয় কিছুটা পরোক্ষ অনুমোদন (!) থাকলেও থাকতে পারে, তবে তার ভাবটা অনেকটা এরকম – ‘তোমরা তোমাদের মতো যা করতে পারো করো- আমি দেখবো না, শুনবো না, বাজেট দেবো না, পরিকল্পনা দেবো না [কিন্তু একটু ত্যাড়াব্যাকা হলেই জরিমানা করবো, জেলে দেবো]। জনগণ ঔষধ খাচ্ছে মনে করে একটু ঠাণ্ডা হয়ে থাকুক।’ আমাদের হোমিওপ্যাথদের কিন্তু এতসব বোঝার দরকার নেই! তাদের ‘রানীর সাথে দেখা নেই কিন্তু কানে কানে কথা’ নাকি ঠিকই চলে।
ইতোমধ্যে আয়ুশের তরফ থেকে ‘সর্দির মতো লক্ষণে [ILI] আর্সেনিকাম এলবাম কাজ করে’ কথার উপর ভিত্তি করে তাকে একেবারে প্রতিরোধক ঔষধ বানিয়ে দেয়া হলো। এবার তার ব্যাপক প্রচারের পরিপ্রেক্ষিতে যখন এর নির্বাচনযোগ্যতা, নির্বাচনের হোমিওপ্যাথিক ও যুক্তিসঙ্গত কারণ, হোমিওপ্যাথির মূলনীতিগুলোর সাথে সেই ঘোষণার সঙ্গতি নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হলো- আয়ুশের অবস্থা হেয় দাঁড়ালো বেগতিক! কোন রকম বাস্তব জ্ঞান, প্রমাণ ও অর্গাননের দেয়া নির্দেশনা ছাড়া এরকম একটা মন্তব্য করাতেও আয়ুশ পড়লো ব্যাপক সমালোচনার মুখে, শক্ত প্রতিরোধের মুখে কিন্তু বাস্তবে এর যুক্তিসঙ্গত উত্তর দেবার সামর্থ্য তার ছিলো না। এবার আয়ুশ সেই ফাপর থেকে বাঁচার জন্য জরিপ, ভোল পাল্টানোসহ বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করলো। অবশেষে আর্সেনিকাম এল্বামকে প্রতিরোধক বলা যাবে না- ইমিউনিটি বুস্টার বলতে হবে মর্মে আদেশ জারি করে বাঁচার চেষ্টা করলো। কিন্তু যে কোন হোমিওপ্যাথ মাত্রই জানেন- হোমিওপ্যাথিক সমস্ত ঔষধই ইমিউনিটি বুস্টার। এই ফালতু ও অকার্যকর শব্দগুচ্ছের আড়ালে যখন তাদের দুর্বলতা, অক্ষমতা ও হঠকারিতাকে ঢাকতে অসমর্থ হলো তখন নতুন এক গাইডলাইনে অতীতের এ কয়দিনের সমস্ত কথা মুছে একেবারে হাত ধুয়ে ফেললো। নতুন গাইডলাইনে কোন প্রিভেনটিভ বা ইমিউনিটি বুস্টারের কথা কথা উল্লেখ নেই। এবার Preventive Measure এর ক্ষেত্রে সাধু সাধু স্বরে বলে দিলো-
“In case of epidemics or pandemics, first approach is to follow preventive measures and educate people about general measures and to provide such interventions which will keep their immunity enhanced.”
সেই সাথে ‘ইমিউনিটি বুস্টারে একমাত্র আর্সেনিকে’র স্লোগান বদলে গিয়ে এবার হলো-
“Several studies are also published which shows the immune modulatory potential of homoeopathic medicines in preclinical studies.”
তারা পরিষ্কার হয়ে গেলো। ইমিউনিটি বুস্টার (Immunity Boaster) বদলে হয়ে গেলো ‘Immune modulatory potential’ এবং সেটিও কেবল আর্সেনিকাম এল্বাম নয়- হোমিওপ্যাথিক সকল ঔষধই (homoeopathic medicines)! আর্সেনিকাম এল্বাম এবার ঠাঁই পেলো মাত্র একটা জায়গায়- মৃদু লক্ষণযুক্ত আক্রমণের জন্য সম্ভাব্য ঔষধের তালিকার দ্বিতীয় স্থানে [একোনাইটের পরে]।
কিন্তু আমাদের কি হলো! আমাদের হোমিওপ্যাথিক বোর্ড কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা-ট্রায়ালের চিন্তা না করে, আয়ুশের অনুসরণে ‘আর্সেনিকাম এল্বাম’কে প্রিভেনটিভ হিসাবে গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে দিলেন। এবং আমাদের একগুচ্ছ চিকিৎসক পরম নিশ্চিন্তে সবাইকে আর্সেনিকাম দিয়ে ইমিউনিটি বুস্ট (!) করতে থাকলেন। হোমিওপ্যাথির মূলনীতি, কর্মপন্থা, আরোগ্যপন্থা, ঔষধ নির্বাচন নীতি সমস্ত কিছুকে তালাক দিয়ে ব্যাপক উৎসাহে সবাই এই ইমিউনিটি বুস্টিংয়ের কাজে নেমে পড়লেন। দুই একজন এর বিরূদ্ধে কথা বলতে গেলে, তার গুষ্ঠি উদ্ধার করতে ছাড়লেন না। এমনকি যুক্তিসঙ্গত প্রশ্নের উত্তরে- আর্সেকিামকে একমাত্র ইমিউনিটি বুস্টার হিসাবে প্রমাণ করতে গবেষণাপত্রের ভূয়া ব্যাখ্যা, তথ্য-বিভ্রাট করে প্রচারণা চালাতেও অনেকে দ্বিধা করলেন না।
গ্রামের পর গ্রাম, বিভিন্ন অফিস আদালত, পুলিশ-প্রশাসনে লক্ষ লক্ষ মানুষকে আর্সেনিকাম এল্বাম এবং কোন কোন ক্ষেত্রে অন্য আরো দু’একটি ঔষধ দেয়া হলো। পেপার-পত্রিকায় লেখালেখি হলো, সংবাদ বেরোলো, সাক্ষাৎকার হলো, ঔষধ বিতরণের ক্যাম্পেইন হলো, হোমিওপ্যাথির সুনাম হলো। কিন্তু এরপর!
বলতে গেলে ঐ কয়দিন ফসল বোনা হয়েছে, এবার তা ঘরে তোলার পালা। কিন্তু যেখানে কেমন মাটি, কেমন বীজ, কি ফল আসতে পারে- তা নিয়ে সামান্যতম চিন্তাও করা হয়নি- সেখানে কি ফল ঘরে আসবে বলে আশা করা যেতে পারে? আসুন সেটা দেখার জন্য, খোদ ইন্ডিয়াতে যে সমস্ত স্থানে এই প্রিভেনটিভ সবচাইতে বেশি ব্যবহার করা হয়েছে- সেখানকার অবস্থাটি একটু প্রত্যক্ষ করে নিই। নিচে ইন্ডিয়ার সরকারী হিসাবে বিভিন্ন প্রদেশের মোট জনসংখ্যা, মোট কনফার্মড আক্রান্ত, কনফার্মড আরোগ্য, মৃত্যু এবং সেই সাথে প্রদেশের মোট জনসংখ্যায় আক্রান্তের শতকরা হার (%), আক্রান্তের মধ্য থেকে মৃত্যুর শতকরা হারের (%) এর তালিকাটি দিচ্ছি-


Mean Confirmed% in total population = 0.05 [প্রদেশের মোট জনসংখ্যার নিশ্চিত আক্রান্তের শতকরার গড়]
Mean Death% in total confirmed cases = 1.36 [প্রদেশের মোট নিশ্চিত আক্রান্তের মাঝে মৃত্যুর শতকরার গড়]
যারা তথ্যসূত্র দেখতে চাইবেন- তারা নিচের ওয়েবসাইটগুলোতে ভিজিট করে দেখতে পারেন-
https://www.mygov.in/corona-data/covid19-statewise-status [Updated 2nd July, 2020]
http://statisticstimes.com/demographics/population-of-indian-states.php [Updated 2019]
বাংলাদেশের চার্ট দিতে পারলাম না। কারণ, এরকম কোন হিসাব নিকাশ সংরক্ষণ করা যায়- সেধরণের কোন ধারণাই বোধহয় আমাদের হোমিওপ্যাথিক কর্তৃপক্ষের মাঝে গড়ে উঠে নি। এবার চার্টটিকে মনোযোগ দিয়ে দেখুন, ৩৬টি প্রদেশের উল্লেখ্য বিষয়গুলোর সমস্ত হিসাব এখানে দেয়া। এর মধ্যে যে তিনটি প্রদেশ গুজরাট, কেরালা, মহারাষ্ট্রে প্রিভেনটিভ ঔষধ হিসাবে আর্সেনিকাম এল্বামকে খুব বেশি বিতরণ করা হয়েছে, তাদেরকে আমি চিহ্নিত করেছি। সাথে দিল্লী ও ওয়েস্ট বেঙ্গলকে চিহ্নিত করেছি- সেখানে সবচাইতে বেশি নির্ভরযোগ্য, বিখ্যাত ও সর্বোচ্চ-সংখ্যক হোমিওপ্যাথদের অবস্থানের কারণে।
ফলাফল কি দেখতে পাচ্ছি? গুজরাট ও মহারাষ্ট্রের অবস্থা ভয়াবহ! গুজরাট মৃত্যুহারে একেবারে পয়লাতে আছে এবং সেটাও একটা মারাত্মক হার নিয়ে, আর দুই নম্বরেই মহারাষ্ট্র। আর কেউ এদের ধারে কাছেও যেতে পারে নি। কেরালাতে বলা চলে উভয় হারই কম আছে কিন্তু সেটাও আরো বহু প্রদেশ যেখানে আর্সেনিকাম এল্বাম এভাবে ঘটা করে দেয়া হয়নি- তার চাইতে বেশি। কেরালার তথ্য আলাদাভাবে ভালো মন্দ কিছুই প্রকাশ করে না। দিল্লী ও পশ্চিমবঙ্গের হোমিওপ্যাথি সেখানে কোন অবদান রেখেছে, তা দেখানোর জো নেই- কারণ উভয়স্থানে মৃত্যুহার অতি-উচ্চমাত্রার।
আমি জানি, এই হিসাব-নিকাশ নিয়ে বহুজনের বহুধরণের আপত্তি, মন্তব্য থাকতে পারে। কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে- সরকারের এই হিসাবটাই শেষমেষ টিকবে। এই হিসাবের উপরই কথা বলতে হবে এবং বাকী সব কথাকে ফালতু ‘ষড়যন্ত্র-তত্ব’ হিসাবে আখ্যায়িত করা হবে। তারপরও যদি কথার খাতিরে সেগুলোকে বিবেচনা করতেও চাই- তবুও সেই পরিসংখ্যান থেকে ‘হোমিওপ্যাথি কিছু একটা করেছে’ তা প্রমাণ করা কি কোনভাবেই সম্ভব?
আর যদি সর্বস্বীকৃত এই তথ্যগুলোকে গ্রহণ করি, তাহলে এই হিসাবের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা কি দেখতে পাবো? দেখবো, যেখানে এই প্রিভেনটিভ ব্যবহার করা হয়েছে, সেখানে মৃত্যুহার কেবল উচ্চই নয়- বরঞ্চ সমস্ত রেকর্ড ভেঙ্গে এই এলাকাগুলোই সর্বোচ্চস্থানে রয়েছে। কথাটা কতটুকু সত্য, আমি তা বলছি না- কতটা এবং কেমন সত্য হিসাবে মানুষের কাছে ধরা দেবে- সেটাকেই আপনাদের সামনে তুলে ধরছি। এবার বলুন, আমাদের অপরিণামদর্শী, ক্ষীণদৃষ্টিময়, বিচক্ষণতাহীন কর্মের ফলাফলস্বরূপ- আমরা আমাদের বিরোধীদের হাতে আমাদের ঘায়েল করার অস্ত্র তুলে দিয়েছি- এই কথাটা কি আমি বাড়াবাড়ি বলে ফেলেছি? কিন্তু এখানেই শেষ নয়!
ইন্ডিয়া এবং আমাদের দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের মাঝে এই প্রিভেনটিভ দেয়া হয়েছে এবং তা প্রিভেনটিভ হিসাবে আদৌ কার্যকর কিনা তার বাস্তব কোন জ্ঞান, প্রমাণ ও হিসাব-নিকাশ ছাড়া। এমনকি ইন্ডিয়ার বেলায় যদি তা প্রিভেনটিভ হয়েও থাকে- আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে তা প্রিভেনটিভ হতে পারে কিনা- সেটাও পরীক্ষা করার বিষয় ছিলো। কিন্তু তা করা হয়নি। আয়ুশের অনুসরণে এখানেও ঘোষিত হয়ে গিয়েছে যে, আর্সেনিকাম এল্বাম খেলে করোনা হবে না।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে- আর্সেনিকাম এল্বাম খেয়েও মানুষের করোনা হচ্ছে। খুব হম্বি-তম্বি, ঘটা করে পুলিশদের আর্সেনিকাম এল্বাম বিতরণ করা হয়েছে; আজ তাদের মধ্যেই ১০,০০০ এরও বেশি পুলিশ-সদস্য নিশ্চিতভাবে করোনা আক্রান্ত। এরা এখন জুতো নিয়ে তেড়ে আসলে- আপনি কি বলবেন?
স্বাধীনতার পর থেকে বহু মহান হোমিওপ্যাথের বহু ত্যাগ, প্রচেষ্টা, সংগ্রাম, উৎসর্গ, নিষ্ঠা ও মনোযোগের বিনিময়ে আজ দেশের সর্বত্র হোমিওপ্যাথি সম্বন্ধে মানুষের মনে সবেমাত্র ইতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হওয়া শুরু হয়েছিলো। কিন্তু তারপরও একটি বিশাল সংখ্যক মানুষের মাঝে ছিলো আমাদের সম্বন্ধে নেতিবাচক ধারণা। বলতে গেলে, সেইসব লোকদের সামনে এখনও এই সমর্থনকারীর দল ধোপে টিকতে পারছিলো না। এবার যখন প্রতিটা গ্রামে, মহল্লায়, শহরে, অফিসে, প্রশাসনে মানুষগুলো আর্সেনিকাম খাওয়ার পরও আক্রান্ত হতে থাকবে- তখন হোমিওপ্যাথি তাদের কোন ধরণের চিন্তায় ঠাঁই পাবে! ৫০ বৎসরে যতজন এ সম্বন্ধে ইতিবাচক হয়েছিলো- এমনও হতে পারে, এই এক ধাক্কায়ই তার চেয়ে বেশি মানুষ নেতিবাচক ধারণা গ্রহণ করবে। হয়তো তারা আন্দোলন, সংগ্রাম, মামলা-হামলা করবে না কিন্তু প্রতিটি মহল্লায়ই সাক্ষ্য দেবার জন্য লোক তৈরি হয়ে যাবে– ‘হোমিওপ্যাথিক ঔষধ কাজ করে না’ [পরীক্ষিত]। আমাদের করা সেই কাজটিরই পরিণতিতে- আমাদের বিরোধীদের হাতে তুলে দেয়া এটি দ্বিতীয় অস্ত্র।
কিন্তু এত বড় ক্ষতি স্বীকার করে, এতটা প্রাণপাত করেও আমাদের অবস্থানটি এখনো কোথায়? স্মরণ করে দেখুন এখনো-
- হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাটিকে সরকারী স্বাস্থ্যব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি
- জরুরি স্বাস্থ্যসেবায় স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হয় নি
- কোন হাসপাতাল অনুমোদন করা হয় নি, এমনকি তাদের হাসপাতাল বা আইসোলেশন সেন্টারগুলোতে সমন্বিতভাবেও কোন স্থান দেয়া হয় নি!
- আমাদের দেশে কোন ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হয় নি [ইন্ডিয়ার নৈমিনাথে একটা হয়েছিলো কিন্তু খোদ ইন্ডিয়া তার ফলাফল সম্বন্ধে নিশ্চিত হলে সেখানে অবশ্যই উপর্যুক্ত কাজগুলো সম্পন্ন হতো। বরঞ্চ এখন আর এটা নিয়ে কোন উচ্চবাচ্যই শোনা যাচ্ছে না।]
- অন্তত আমাদের দেশে এক পয়সা বাজেট বরাদ্দ হয় নি
- কোন গবেষণার অনুমোদন দেয়া হয় নি
- সরকারের তরফ থেকে চিকিৎসা করার সুস্পষ্ট অনুমোদনটাও কি আসলে এসেছে!
এমনকি রাজারবাগ পুলিশলাইনে কোন হোমিওপ্যাথ করোনার চিকিৎসা দিচ্ছে- সেটাও যে মুখ মুছে অস্বীকার করা হয়েছে, তা বোধহয় আপনারা ইতোমধ্যে সবাই অবগত; এমনকি তাদের কথা মোতাবেক, সেখানে ডা. রাশেদ কভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীকে চিকিৎসা দেবারই অধিকার রাখেন না। মধ্যখান থেকে কয়েকজনের জেল, জরিমানা, মামলা পর্যন্ত হয়ে গিয়েছে। এই সার্বিক চিত্র কিসের ইঙ্গিত করে! সবাই কি ঘুমিয়ে আছেন?
ঘুমিয়ে আছেন, এই প্রশ্নটি এখন উঠতেই পারে। মূলত আমাদের হোমিওপ্যাথিক কর্তৃপক্ষের যা যা করা উচিৎ ছিলো এবং বাস্তবক্ষেত্রে যা যা হয়েছে তার তুলনা করলে। হোমিওপ্যাথদের আত্মনিবেদনকে সার্থক করতে, তাদের ঝুঁকিগ্রহণকে মূল্যায়ন করতে এবং দেশে ও পৃথিবীতে হোমিওপ্যাথির সম্মান, এর সক্ষমতার প্রমাণকে সুস্পষ্ট করতে আমাদের কর্তৃপক্ষেরে যে কাজগুলো করা উচিৎ ছিলো-
- শুরুতেই হোমিওপ্যাথির সক্ষমতার ইতিহাস তুলে ধরে কভিড-১৯ মোকাবেলায় সরকারের কাছে উপযুক্ত পদ্ধতিতে আবেদন করা, আইসোলেশন সেন্টারগুলোতে ও হাসপাতালগুলোতে, অন্তত সমন্বিতভাবে হলেও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা প্রদানের অনুমতির আবেদন করা।
- অর্গানন প্রদত্ত নিয়ম অনুযায়ী, সেখানে কৃত চিকিৎসার মাধ্যমে জেনাস এপিডেমিকাস নির্ধারণের প্রচেষ্টা চালানো।
- কার্যকর অবকাঠামো নিশ্চিত করা- যাতে সেই কেন্দ্রিয় চিকিৎসার পর্যবেক্ষণ, ফলাফল, তথ্য-উপাত্ত ও সিদ্ধান্ত- তৃণমূল পর্যায়ের চিকিৎসকগণ সাথে সাথে অবগত হতে পারেন ও তদনুযায়ী চিকিৎসা পরিচালনা করতে পারেন।
- হোমিওপ্যাথদের আবেদনকৃত রোগীদেরকে যেন RT-PCR টেস্ট করতে পারাটা নিশ্চিত হয়- তার বন্দোবস্ত করা। প্রয়োজনে নিজেদের হাসপাতালগুলোতে কিছু টেস্ট কিট বন্দোবস্ত করা।
- সারাদেশে হোমিওপ্যাথগণ তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী যেন সুষম ও পদ্ধতিগতভাবে চিকিৎসাপ্রদান করতে পারেন- তা নিশ্চিত করা এবং তাদের সমস্ত রেকর্ড সংরক্ষণের বন্দোবস্ত করা।
- প্রয়োজনে বাজেটের জন্য জোরদার আবেদন করা। [দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে দেখাতে পারলে, যা পাওয়া একেবারে অসম্ভব ছিলো বলে আমি মনে করি না, বিশেষ করে আগের কাজগুলো ঠিকঠাকভাবে যথাসময়ে সম্পন্ন করতে পারলে]
- প্রিভেনটিভ বা জেনাস এপিডেমিকাস পাওয়া গেলে- তার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সম্পন্ন করা ও সমস্ত প্রমাণ প্রকাশ ও সংরক্ষণ করা। এরপর তদনুযায়ী সারাদেশের সর্বসাধারণের মাঝে সেই ঔষধপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা।
- জেনাস এপিডেমিকাস না থাকলে, বা না পাওয়া গেলে, বা সুস্পষ্ট না হলে- তা গ্রহণে সুস্পষ্টভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে- ব্যক্তিস্বাতন্ত্রিক চিকিৎসাপদ্ধতির (Individualised Treatment) ব্যাপারে পূর্ণ দিক-নির্দেশনা দেয়া এবং তদনুযায়ী তা বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা সেটি মনিটর করা।
- সমস্ত চিকিৎসা-বিবরণী, তথ্য-উপাত্ত, সিদ্ধান্ত ও তার যুক্তিসঙ্গত কারণ, ফলাফল, আরোগ্যের হার, পরিসংখ্যান, ব্যর্থতা ও তার কারণ, অগ্রগতির হার ইত্যাদি বিষয়ে প্রতিদিন আপডেট দেয়ার বন্দোবস্ত করা।
- অন্যান্য চিকিৎসার তুলনায় এবং অন্যান্য দেশের তুলনায় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার ফলাফল কি আসছে তার প্রামাণ্য ও পারিসাংখ্যানিক হিসাব-নিকাশ সংরক্ষণ ও প্রকাশ করা।
এটা আবার বলবেন না যে, চোর পালানোর পর আমার বুদ্ধি বেড়েছে! এগুলোর ব্যাপারে কথা আমি আগেই বলেছি, এছাড়া আরও কিছু বিচক্ষণ হোমিওপ্যাথ এই বিষয়গুলোর সবগুলো নিয়েই কথা বলে এসেছেন। কিন্তু একটা কাজও কি হয়েছে! এর মাত্র একটা কাজও কি সম্পন্ন করা হয়েছে? তাহলে এতদিন করেছেনটা কি? সরকারের কাছে, দেশের মানুষের কাছে, পৃথিবীর কাছে, এমনকি নিজেদের কাছেও বিন্দুমাত্র বিচক্ষণতা, সুপরিকল্পনা, সংগঠিত কর্মপদ্ধতি প্রদর্শন করা সম্ভব হয় নি কিন্তু সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেছে- ইউনিভার্সিটি, হাসপাতাল ও রিসার্চ সেন্টার প্রস্তাবের। যেখানে উপরের পরিশ্রমটুকু করার অনুমতিই আমাদের কর্তৃপক্ষগণ সরকারের কাছ থেকে জোগাড় করতে পারেন নি, সেখানে তারা এগুলো করবেন সে আশা করাটি কতটা বাস্তবসম্মত! একটু বেশিই প্রত্যাশা হয়ে যায় না! এমন তো নয় যে, এগুলো নিজেদের করোনা চিকিৎসার ক্ষেত্রে চলমান অক্ষমতাগুলো, নিজেদের এতদিনকার অপরিণামদর্শিতাকে, সাংগাঠনিক কর্মপ্রক্রিয়া সম্পাদনের ব্যর্থতাকে, সরকারকে হোমিওপ্যাথি সম্বন্ধে প্রত্যয় সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হবার, বা নিজেরা ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে না পারার কাপুরুষতাকে ঢাকবার কুটিল প্রয়াস! হয়তো এই শাকগুলোর আড়ালে মাছটা ঢাকা পড়ে গেলো- কি চমৎকার! হোমিওপ্যাথরা আলোচনা করার নতুন একটা ইস্যু পেয়ে, এই নতুন বিষয়টির সম্ভাব্যতা-অসম্ভাব্যতা নিয়ে, তার পরিকল্পনা ও স্বপ্ন নিয়ে, পদ-পদবী নিয়ে কিংবা তার বিরোধিতা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলো! দলাদলি হলো, গালিগালাজ হলো! বিশ্ববাসী, সরকার ও জনগণ হোমিওপ্যাথদের ব্যর্থতাকে গালাগালি করতে থাকুক- আমরা বোকার স্বর্গে বাস করতেই থাকি!
আমি উচ্চশিক্ষা ও হোমিওপ্যাথির উন্নতি, প্রগতির বিরূদ্ধে নই- থাকার প্রশ্নই উঠে না; নয়তো এত কষ্ট করে (বহুজনের সম্ভাব্য গালাগালিকে মেনে নিয়ে) এত কেচ্ছা লেখার প্রশ্নই উঠতো না। কিন্তু আমি কল্পনার জগতেও বাস করি না- বাস্তবতা আমার কাছে বাস্তবতাই। আজকে দেশে ইউনিভার্সিটি, হাসপাতাল ও রিসার্চ সেন্টারের প্রস্তাব দাঁড় করানো হচ্ছে। কিন্তু একটি বারও কি আপনাদের ভাবনায় আসে নি- ইউরোপ, আমেরিকার মতো গণতন্ত্রের চর্চাকারী, তুলনামূলক কম দুর্নীতিপরায়ণ দেশে- যেখানে হোমিওপ্যাথিক পড়াশুনা করার জন্যও এমবিবিএস পাশ হতে হতো এবং যেখানে আমাদের দৃষ্টান্ত দেবার মতো শীর্ষস্থানীয় ও অগ্রপথিক হিসাবে স্বীকৃত হোমিওপ্যাথগণ ছিলেন, যেখানে বহু সংখ্যক মানসম্পন্ন কলেজ, ইউনিভার্সিটি ও হাসপাতাল ছিলো- সেগুলোরই আজ কি দশা! সেগুলোকে তো একসময় রাজা-বাদশাহেরাও পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন! তাদের একসময় সুদৃঢ় ভিত্তি থাকার পরও এবং সফলতার অসংখ্য প্রমাণ ও রেকর্ড থাকার পরও- কি পরিণতি হয়েছে! আমরা যেখানে ২৩৮ জন চিকিৎসককে নিয়ে সুশৃঙ্খলভাবে চিকিৎসা-পরিকল্পনা সাজাতে অসমর্থ – সেখানে এত বিশাল বিশাল পরিকল্পনাকে ফাঁকা বুলি মনে হওয়া কি অসম্ভব চিন্তা? অনুমতি দেবার আগেই তো প্রশ্ন উঠবে- আমরা কি করেছি? কতটা করতে পেরেছি? তার প্রমাণ কি? রেকর্ড কোথায়? আর সেটাই আমি এতটা দিন ধরে বলে এসেছি। নিজেদের পা’কে দৃঢ় না করতে পারলে- মাথায় ফড়িং বসলেও টসকে যেতে হবে। কিন্তু যদি আমাদের মধ্যে সেই যোগ্যতার সৃষ্টি হয়, যদি সরকারকে-দেশের জনগণকে আমরা আমাদের সক্ষমতার প্রমাণ দিতে পারি, তাহলে এগুলো আমরা না চাইলেও হবে এবং তখন ষড়যন্ত্রের ঝড়ো তুফানও আমাদের পা’কে টলাতে পারবে না, উচ্ছেদ করতে পারবে না।
আমাদের দেশের হোমিওপ্যাথি এখন এতটাই অক্ষম হয়ে পড়ে আছে যে- সরকারের কাছেও এর চিকিৎসা পরিকল্পনা তিনটি আলাদা আলাদা স্থান থেকে প্রস্তাব করা হয়েছে এবং সেটিও দেশে আক্রান্ত ঘোষণা হবার কয়েকমাস পরে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের কথা উঠলে, ১০ টাকার টিকিট কেটে মুখ দেখাতে আসা রোগীদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, রোগীশূণ্য এক হোমিওপ্যাথিক আইসোলেশন সেন্টার প্রস্তুত করা হয়েছে- যেখানে করোনা আক্রান্ত রোগী নিশ্চিত হলে নাকি ত্বরিৎগতিতে স্পেশালাইজড এলোপ্যাথিক হাসপাতাল পাঠিয়ে দেয়া হবে, হটলাইন চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা হয়েছে- যারা আদৌ করোনা আক্রান্ত রোগী কিনা তা নিশ্চিত হবার কোন পন্থা নেই; কোন রেকর্ড নেই, কোন জরিপ নেই, কোন তথ্য-উপাত্ত নেই- ঢালও নেই, তলোয়ারও নেই- সব নিধিরাম সর্দার হয়ে হাসি হাসি মুখ করে মিডিয়াতে এসে ‘হোমিওপ্যাথির জয়’ বলে শ্লোগান দিচ্ছে।
এই বালির বাঁধ এবার ভেঙ্গে পড়তে শুরু করেছে। অতীতে বহুবার আমি সতর্ক করে এসেছি, আজকেও আমাদের দেশের হোমিওপ্যাথিক কর্তৃপক্ষ, ও হোমিওপ্যাথদের আবারও বলছি- যেখানে করোনা মহামারীতে সঠিক পদক্ষেপ আমাদের জন্য আশির্বাদ হয়ে দেখা দিতে পারতো, সেখানে আমাদের ব্যর্থতা ও হঠকারিতার জন্য আজ আমরা মহাসর্বনাশের দ্বারপ্রান্তে। যেখানে বিগত প্রায় আড়াইশো বৎসরের সাফল্য আমাদের বিরোধীপক্ষের মন গলাতে পারে নি, সেখানে তথ্য-উপাত্ত-রেকর্ডবিহীন গুটি কয়েক শ্লোগান, মুখে মুখে ফেরা সাফল্যগাঁথা, মিডিয়াতে দেয়া ফাঁকা সাক্ষাৎকার – তাদের সামনে কিন্তু ধোপে টেকার ওয়েটিং লিস্টের জন্যও দাঁড়াতে পারবে না। বর্তমান সময়ে চেষ্টাকৃত প্রচারিত হোমিওপ্যাথির এই সাময়িক প্রশংসাটুকুকেও তারা ভালোভাবে নেবে এটা আশা করার কোনই কারণ নেই। তারা আসছে- কিন্তু আমরা প্রস্তুত তো! আমরা তাদের হাতে আজ অস্ত্র তুলে দিয়েছি কিন্তু এই সর্বনাশ ঠেকানোর পথ বোধহয় এখনও শেষ হয়ে যায় নি। উপযুক্ত কাজগুলো করতে পারলে এবং ত্বরিৎগতিতে সংশোধনীমূলক কর্মপন্থা নিশ্চিত করতে পারলে, আশু বিপর্যয়ের হাত থেকে হয়তো এখনো রক্ষা পাওয়া সম্ভব। আমার আবেদন থাকবে- এই শেষ সময়টাতে অন্তত সবাই সতর্ক হোন- নয়তো আগামীতে পিঠ ও গাল কোনটাই হয়তো বাঁচানো সম্ভব হবে না।
Discussion about this post