ডা. শাহীন মাহমুদ:
“এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, বাংলাদেশে বাস করা ৯৯% মানুষই হোমিওপ্যাথিক ঔষধের আরোগ্যকারী ক্ষমতা সম্বন্ধে সচেতন নয়। তারা মনে করে এলোপ্যাথিক ঘরানার চিকিৎসাই নির্ভরযোগ্য, এবং হোমিওপ্যাথিতে তারা আরাম পেতেও পারেন আবার নাও পেতে পারেন- এ ব্যাপারে না আছে কোন গ্যারান্টি, না করা যায় আরোগ্যের তেমন কোন আশা।… … … বাস্তবে, আমাদের দেশের হোমিওপ্যাথিক পদ্ধতির চিকিৎসা অনেকটা- পাপকে ঠেকাতে বড় পাপ করার মতো অবস্থা। অযোগ্য এবং নিম্নমানের হোমিওপ্যাথদের মাধ্যমে এর সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে। তারা পুরোপুরি একজন রোগীর কেইস হিস্ট্রি লিখেন না, যা করতে বেশ খানিকটা সময় লাগে কিন্তু সঠিক ঔষধ নির্বাচনের জন্য যা অপরিহার্য। অলস, অসৎ চিকিৎসকগণ শুধুমাত্র দু’একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেই প্রেসক্রাইব করেন। রোগীগণ খুব একটা আরাম পান না, আরোগ্য হন না”… … …।
না, এই কথাগুলো আমার লেখা নয়। ২০১৭ সালের জানুয়ারি সংখ্যায় জনপ্রিয় হোমিওপ্যাথিক জার্নাল Hpathy ezine এ Dr. Salma Afroz তার পেপারে বাংলাদেশের হোমিওপ্যাথির যে ভাবমূর্তি বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছেন তার কিছু অংশের অনুবাদ আমি উল্লেখ করলাম।
হয়তো অনেকেই ডা. সালমা আফরোজের উপর ক্রোধান্বিত হবেন, কিংবা আশা করবেন আমিও তার মুন্ডপাত করা শুরু করবো। কিন্তু বিশ্বে বাংলাদেশের হোমিওপ্যাথির এই ভাবমূর্তি সাগ্রহে তুলে ধরার ঘটনাটা আমার খারাপ লাগলেও, নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবলে তার পর্যবেক্ষণের বাস্তবতাটা কি উপেক্ষা করতে পারবো? তিনি তার লেখায় এদেশের চিকিৎসকদের সম্বন্ধে আরো তুলে ধরেছেন- আন্দাজে প্রেসক্রিপশন করার অভ্যাস, অর্গাননকে ফলো না করে একাধিক ঔষধ একসাথে প্রেসক্রিপশন করার অভ্যাস, টনিক এবং কম্পাউন্ড ঔষধ ব্যবহার করে রোগীদের কাছ থেকে বেশি বেশি অর্থলাভের প্রচেষ্টা, ম্যাজিক ফললাভের আশায় মাদার-টিংচার ব্যবহার প্রবণতা, ভুল-নির্বাচনের ঔষধ অতিরিক্ত ব্যবহার, অতিরিক্ত রিপিটেশন ইত্যাদি। এই কথাগুলোর সত্যতা সম্বন্ধে কি আমরা অস্বীকার করতে পারবো? সুস্থ চিন্তাশক্তি ব্যবহার করে ভাবলে, অস্বীকার করার উপায় নেই।
কিন্তু সেই সাথে এটাও সত্য, যুগের পর যুগ বাংলাদেশে হোমিওপ্যাথিক শিক্ষাক্ষেত্রে একধরনের অসহায়ত্ব বিরাজ করছে । ইন্সটিটিউশনে, কলেজে অপর্যাপ্ত শিক্ষা, কলেজগুলোতে দুর্নীতি ও এগুলোর দুরবস্থা, শিক্ষার মানোন্নয়নে অবহেলা, নিয়ন্ত্রণ ও অবকাঠামোগত দুর্বলতা, সঠিক ব্যবস্থাপনা ও দিক-নির্দেশনার অভাব- এগুলো আমাদের নিত্য সহায়। আমরা ‘ক্লাসিক্যাল হোমিওপ্যাথি’, ‘অর্গাননের নীতির ব্যবহার’ এগুলো শুধু বুলি হিসাবে শুনে আসছি। কতজন চিকিৎসক নিজ চোখে এগুলোর ব্যবহার প্রত্যক্ষ করেছেন? এমনকি আমাদের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষকগণের চেম্বারেও কি এই নীতিগুলোর যথাযোগ্য প্রয়োগ দেখা যায়?
বাংলাদেশে হাজার হাজার চিকিৎসক ক্লাসিক্যাল হোমিওপ্যাথিকে ভালবাসেন, ভালবাসেন হানিম্যানকে, ভালোবাসেন হোমিওপ্যাথির মূলনীতিকে, এমনকি তারা প্রকৃত নীতি অনুসারে চিকিৎসা না করলেও। আমি খুব ভালো করে লক্ষ্য করে দেখেছি, সামান্য সুযোগ পেলে বিনয়ী চিকিৎসকগণ কিভাবে, কতটা আগ্রহে শেখার জন্য উন্মুখ হয়ে পড়েন। কিন্তু স্বল্প ইংরেজি জানা এই বিশাল চিকিৎসক সমাজের কাছে হোমিওপ্যাথির মূলনীতিগুলো পৌছানোর রাস্তা কি আদৌ আমাদের দেশে আজ পর্যন্ত কেউ তৈরি করার চেষ্টা করেছেন? বাংলাদেশের গুটিকয়েক অপর্যাপ্ত সংখ্যার লেখক হয়তো আছেন, কিন্তু হোমিওপ্যাথির মূলনীতিগুলোকে আয়ত্ব করতে, বিদেশে অনুবাদকৃত বই বাংলাদেশে পাওয়ার কোন সহজলভ্য উপায় কি আজো তৈরি হয়েছে? কিংবা, আমাদের দেশে হোমিওপ্যাথির ক্লাসিক ইংরেজি বইগুলোর অনুবাদের কোন ব্যবস্থা?
এই ব্যবস্থার কথা না হয় বাদই দিলাম। আমাদের দেশে বিজ্ঞ হোমিওপ্যাথদেরও সামাজিক সম্পর্কের কি অবস্থা? সিনিয়র-জুনিয়র, বস-এসিস্ট্যান্ট, বিএইচএমএস-ডিএইচএমএস, জ্ঞানী ডাক্তার-মূর্খ ডাক্তার, ইংরেজি জানা ডাক্তার- ইংরেজি না জানা ডাক্তার, অভিজ্ঞ ডাক্তার-আনাড়ি ডাক্তার, এই গ্রুপ-সেই গ্রুপ, এই মেথড-সেই মেথড ইত্যাদি; শ্রেণি বিভাগের আসলেও কি কোন শেষ আছে? শুধুমাত্র আমাদের মধ্যে সুদক্ষ, সুশিক্ষিত চিকিৎসকগণও যদি সুশৃঙ্খলভাবে সবার মধ্যে তাদের জ্ঞানকে ছড়িয়ে দেবার সুযোগ পেতেন, হাতে-কলমে শিক্ষার সুন্দর ব্যবস্থাপনা থাকতো, তাহলেও আমাদের শিক্ষা-ঘাটতি অনেকটাই পূরণ হতে পারতো। কিন্তু স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশত বৎসর পরে, চিকিৎসার অন্যান্য শাখা এগিয়ে গেলেও, আমরা হোমিওপ্যাথগণ যে ভাগারে ছিলাম এখনো প্রায় সে ভাগারেই। বাংলাদেশে হোমিওপ্যাথির অনেক সংগঠন, সঙ্ঘ-সমিতি হয়তো হয়েছে, কিন্তু কেউ কি সক্রিয়ভাবে কাজ করতে পেরেছেন- দেশের আনাচে-কানাচে সঠিক ও প্রকৃত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার পদ্ধতিগুলোকে পৌছে দেবার প্রশ্নে? অনৈক্য, দুর্নীতি, আত্ম-অহমিকা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহযোগিতার অভাব, হোমিওপ্যাথিকে ভালোবেসে মানবকল্যাণে নিজেকে নিবেদিত করার মানসিকতার অভাব- আমাদের সমাজ সম্পর্কে বিশ্বের বুকে উল্লেখিত রকম ভাবমূর্তি তুলে ধরার সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছে।
যাই হোক, ভালো লাগুক বা না লাগুক, আজ আমাদের এই অবস্থা আমরা নিজেদের মনের কাছে স্বীকার করতে বাধ্য। কিন্তু এগুলো এখানে সেখানে আলোচনা করা- এ থেকে উত্তরণের পথও নয় এবং কাম্যও নয়। সমস্যাকে চিহ্নিত করে আমাদের সমাজের অন্তত কিছু নিঃস্বার্থ চিকিৎসকের এগিয়ে আসাটাই হতে পারে, এই অবস্থা থেকে নিষ্কৃতির প্রথম পদক্ষেপ। এমন কয়েকটি দেশের কথা উল্লেখ করা যায়, যেখানে প্রাথমিকভাবে হোমিওপ্যাথি সম্বন্ধে স্বল্পজ্ঞানী গুটিকয়েক চিকিৎসকের উদ্যোগে শুরু হওয়া প্রচেষ্টার ফলে পুরো দেশটিতে হোমিওপ্যাথির আজ জয়-জয়কার। শুধু সরকারী ব্যবস্থাপনার ভরসায় থাকলে, পৃথিবীর কোন দেশই কোনদিন হোমিওপ্যাতির মুখদর্শন করতে পারতো কিনা সন্দেহ। সেখানে আমার বিশ্বাস বাংলাদেশে অনেক সুযোগ্য, প্রচন্ড মেধা ও ধী-শক্তি সম্পন্ন চিকিৎসক রয়েছেন, আছেন ক্লাসিক্যাল হোমিওপ্যাথিকে ভালোবাসে, তাকে শিখতে চায়, আয়ত্ব করতে চায় এরকম হাজারো চিকিৎসক এবং শিক্ষার্থী।
দেশের হাজার হাজার চিকিৎসককে অসহায় রেখে, শুধুমাত্র গুটিকয়েক ব্যক্তি জ্ঞান-অর্জন করে, তার আড়ম্বর করলে, ফেইসবুকে হম্বি-তম্বি করলে, তাতে কারোরই বিন্দুমাত্র লাভ হবে না। আজ হোক বা কাল, নিজেদের অস্তিত্বই সঙ্কটের মুখে পড়ে যাবে, এটা নিশ্চিত। এখন উচিৎ, বাংলাদেশে তাদের প্রচেষ্টা ও উদ্যোগে এমন কোন ব্যবস্থা করা যাতে আমাদের বিনয়ী, শিখতে আগ্রহী হাজার হাজার চিকিৎসক ও শিক্ষার্থী ঐক্যবদ্ধ হতে পারেন, পেতে পারেন নিজ ভাষায় তাদের শেখার উপকরণ, বিদেশী বইগুলো তাদের কাছে সহজপ্রাপ্য হয়, পারস্পরিক সহযোগিতা ও সম্প্রীতির ভিত্তিকে শক্তিশালী করা হয় হোমিওপ্যাথিক সমাজের ভিত্তি। যেন এই অসহায় চিকিৎসক সমাজ তাদের মাথার উপর ছাতা হিসাবে পায় দিক-নির্দেশনা, জরুরি মুহূর্তে পরামর্শ, শিক্ষা ও জ্ঞান। এবং সেইসাথে মাঠ-পর্যায়ে তারা হোমিওপ্যাথির প্রচার ও প্রসারে নিজেদেরকে নিবেদিত করার মতো মনোবল। পারস্পরিক সক্রিয় সমর্থনের ভিত্তিতে, যাতে দুর্বল চিকিৎসক ধীরে ধীরে সবল হয়ে উঠেন, জ্ঞানের স্বল্পতাকে অতিক্রম করে পেতে পারেন পূর্ণতা। নিজের সাধ্যাতীত রোগীদের পরম নির্ভরতায় পরিচিত সুযোগ্য চিকিৎসকের নিকট রেফার করে অক্ষুন্ন রাখতে পারেন, হোমিওপ্যাথির সুনাম। হানাহানি, কাদা ছোড়াছুড়ি বন্ধ করে, এখন গড়ে তুলতে পারেন একটি আদর্শ হোমিওপ্যাথিক কম্যুনিটি।
আমার এ কথাগুলো আজ লেখার পেছনে একটা কারণ আছে। বিগত কয়েকবছরে আমি বেশকিছু চিকিৎসককে দেখেছি, যারা অত্যন্ত বিনয়ের সাথে আমার কাছে এসেছেন হোমিওপ্যাথির মূল আদর্শ, নীতি ও পদ্ধতিকে বুঝতে, আয়ত্ব করতে। এদের মধ্যে অনেকেই আমার চাইতে বয়সে অনেক বড়। ডা. সালমা আফরোজের উল্লেখিত সমস্ত দোষে দুষ্ট থাকলেও, তা থেকে মুক্ত হয়ে প্রকৃত ধারার হোমিওপ্যাথির আস্বাদ লাভের জন্য ছিলো তাদের ব্যাকুল আকাঙ্ক্ষা। চরম বিনয় নিয়ে তারা অপেক্ষা করছেন, সামান্য সুযোগের। আমি মনে করি, এই বিনয়ী, হোমিওপ্যাথির প্রতি নিবেদিত কিন্তু জ্ঞানে অসম্পূর্ণ সমাজকে কোনভাবে উত্তরণ করতে পারলেই শুধুমাত্র বাংলাদেশে হোমিওপ্যাথির অপরিহার্য এবং সুদৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করা সম্ভব। নয়তো, সর্বত্র আমাদের অবস্থা থাকবে নড়বড়ে, সংখ্যায় বিশাল হয়েও আমরা থাকবো ভিত্তিহীন এবং সেটাও বিভিন্ন জন বিভিন্ন স্থানে মুখরোচক আলোচনার বিষয়বস্তু করে ফায়দা লুটবে, অন্যান্য দেশের গ্রুপগুলোতে আমাদের নিয়ে চলবে বিদ্রুপ ও হাসাহাসি। এখন প্রয়োজন সুস্থ চিন্তা, নিবেদিতপ্রাণ কর্ম, ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা, সৃদৃঢ় কম্যুনিটি।
Discussion about this post