[ডা. এস. পি. দে-এর বইয়ের একটি অধ্যায়ের বাংলা অনুবাদ]
অনুবাদ: ডা. শাহীন মাহমুদ
যে কেইসগুলো, এমনকি হোমিওপ্যাথিক দৃষ্টিকোণ থেকেও আরোগ্যযোগ্যতাহীন বলে বিবেচনা করা হয়, সেগুলোতেও হোমিওপ্যাথির ভূমিকা একেবারে কম নয়। সম্পূর্ণ Optic atrophy কখনোই আরোগ্য করা যাবে না কিন্তু আংশিক Optic atrophy-র ভয়াবহ পরিণতিকে হয়তো রুদ্ধ করা যাবে এবং তদনুযায়ী রোগীকে রক্ষা করা যাবে অন্ধত্বের হাত থেকে। একটি রেনাল ফেইলিউরের রোগীকে আরোগ্য করা হয়তো অসম্ভব, কিন্তু রোগীকে তার কষ্ট থেকে উপশম দেয়া বেশ ভালোভাবেই সম্ভব এবং তেমনিভাবেই সম্ভব তার প্রত্যাশিত আয়ুটিকে দীর্ঘায়িত করা। Congenital heart disease বা এ ধরণের অস্বাভাবিকতাগুলো কোন ঔষধ দিয়েই আরোগ্যযোগ্য নয়। কিন্তু রোগীগণ যদি জীবনের প্রত্যেকটি অঙ্গণে সংযমী আচরণ অবলম্বনের দিকে লক্ষ রাখে, তাহলে হোমিওপ্যাথি এ প্রকারের রোগীগুলোকে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় লক্ষণমুক্ত রাখতে পারে।
Thalassemia, sickle cell anemia, G-6-P-D deficiency, hemophilia ইত্যাদি জেনেটিক রোগগুলো সাধারণত আরোগ্যসীমার বাইরে। কিন্তু এ ধরণের রোগীদের ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথি মোটামুটি একটি যন্ত্রণাবিহীন জীবনের ব্যবস্থা করে দিতে পারে। ক্যান্সার, লিভার- সিরোসিস, সেরিব্রাল টিউমার ইত্যাদি রোগগুলো বহুদূর এগিয়ে গেলে নিঃসন্দেহে তা আরোগ্যযোগ্যতাহীন। এ প্রকারের কেইসগুলোতে লক্ষণসংশ্লিষ্ট উপশম প্রদান ছাড়া আর বেশি কিছু করা সম্ভব নয়। তথাপি এই রোগীগণ তাদের তীব্র যন্ত্রণাগুলো থেকে আরাম পেতে পারেন- কাজেই হোমিওপ্যাথি অন্তত একটি যন্ত্রণাবিহীন ও শান্তিময় চিরবিদায় প্রাপ্তিতে সহায়তা করতে পারে।
চিকিৎসা-আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো নিয়েও সমস্যার উদ্ভব হতে পারে। গলার সমস্যাজনিত খাদ্যগ্রহণে অপারগতার ক্ষেত্রে টিউবফিডিং অথবা ইন্ট্রাভেনাস ফ্লুইডের মাধ্যমে পুষ্টি সরবরাহ, মূত্ররোধের ক্ষেত্রে ক্যাথেরাইজেশন, তীব্র শ্বাসকষ্টে অক্সিজেনেশন, তীব্র রক্তশূণ্যতাতে ব্লাড ট্রান্সফিউশন ইত্যাদি ব্যাপারগুলো পূর্বে উল্লেখ করা সঙ্কটময় ক্ষেত্রগুলোতে জরুরি হয়ে পড়ে। এ ধরণের কেইসগুলোতে, রোগীর অন্তত শান্তিময় মৃত্যুর জন্য হোমিওপ্যাথ ও প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থার চিকিৎসকগণের পারস্পারিক সহযোগিতা আকুলভাবে কাঙ্ক্ষিত হওয়া উচিৎ। এ সমস্ত কেইসগুলোতে, উভয় ব্যবস্থা একে অপরের সম্পূরক বলে অবশেষে প্রমাণিত হবে।
বর্তমান সময়ে ঔষধসৃষ্ট রোগ (Iatrogenic disease) আরোগ্যযোগ্যতাহীন রোগগুলির তালিকায় একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। ঔষধসৃষ্ট রোগগুলিতে ভুগছে এরকম বিপুল সংখ্যক রোগীকে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকগণের চিকিৎসা করতে হয়। রোগীগণ পূর্বে যে ঔষধগুলো সেবন করেছে, প্রায় ক্ষেত্রেই সেগুলোর নাম রোগী সরবরাহ করতে না পারায়- বেশিরভাগ কেইসেই আমরা ব্যর্থতার মুখোমুখি হই। তার ফলে যথাযথ এন্টিডোট নির্বাচন করতে পারা যায় না। ঔষধ হোমিওপ্যাথিক নীতি অনুসারে উত্তমভাবে নির্বাচিত হলেও, কাঙ্ক্ষিত ফলটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এই রকম কেইসগুলোতে, আগে গ্রহণ করা ঔষধের নামগুলো যদি জানা যেতো, তাহলে হয়তো যথাযথ এন্টিডোট প্রয়োগ করা সম্ভব হতো। পরবর্তীতে সুনির্বাচিত হোমিওপ্যাথিক ঔষধ যথাযথ শক্তি ও মাত্রা বা মাত্রাগুলিতে প্রয়োগ করা হলে, আরোগ্যযোগ্যতাহীন কেইসগুলোও আরোগ্যের পথে নিয়ে আসা যেত। প্রায়শই ঔষধসৃষ্ট ক্ষেত্রগুলোর মাধ্যমে রোপিত পরিবর্তিত অবস্থাটির দরুণ রোগীর প্রকৃত লক্ষণচিত্র প্রাপ্তিটা একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।
বহু কেইসে রোগীর ইতিহাসের সতর্ক এনামনেসিস এবং ঔষধগুলো প্রয়োগের আগের ও পরের অবস্থাগুলোর তুলনামূলক পর্যালোচনা- একটি সম্পূর্ণ লক্ষণচিত্র পেতে সক্ষম করতে পারে কিন্তু যদি আমরা ঔষধসৃষ্ট লক্ষণগুচ্ছের ভিত্তিতে সাধারণভাবে ঔষধ নির্বাচন করি- তা রোগীর আরোগ্য, এমনকি সামান্য উপশম দানেরও পরিবর্তে তার কষ্টগুলোকে আরো বৃদ্ধি করবে। ঔষধসৃষ্ট কারণে যেখানে উক্ত কেইসগুলো দুঃসাধ্য এবং আরোগ্যযোগ্যতাহীন হয়ে গেছে, এমনকি সেখানেও হোমিওপ্যাথি একটি সুর্নিদিষ্ট ভূমিকা রাখতে পারে- এটা অনস্বীকার্য। আমরা যদি আমাদের ভূমিকা যথাযথভাবে পালন না করি, আরোগ্যযোগ্যতাহীন কেইসের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়ে যেতে পারে। চিকিৎসকদের সাথে সাথে রোগীদেরও এ ব্যাপারে সতর্ক ও সচেতন হবার এখনই চূড়ান্ত সময়।
আরোগ্যযোগ্যতাহীন রোগোদ্ভবের প্রতিরোধের ব্যাপারে হোমিওপ্যাথির ভূমিকাকে এবার আলোচনা করা যাক। সন্তান নেবার আগে পিতা-মাতা উভয়ই যদি এন্টিমায়াজমেটিক কন্সটিটিউশনাল চিকিৎসা গ্রহণ করেন, তাহলে আরোগ্যযোগ্যতাহীন রোগ বা বিকলাঙ্গতা নিয়ে জন্মানো শিশুর সংখ্যা সর্বনিম্ন মাত্রায় কমিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে। জেনেটিক রোগ হয়তো কখনোই একেবারে দূর করা সম্ভব হবে না কিন্তু পিতা-মাতার, বিশেষ করে প্রেগনেন্সিকালীন সময়ে মায়ের এন্টিমায়াজমেটিক কন্সটিটিউশনাল চিকিৎসা- এই সমস্ত রোগগুলোর তীব্রতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেতে সহায়তা করতে পারে। AIDS, cancers, leukemia ইত্যাদি রোগগুলো হোমিওপ্যাথিতে নতুন নয়। হোমিওপ্যাথিক নীতি অনুসারে, রোগ-প্রতিরোগ শক্তির ঘাটতি সমস্ত রোগের মূল। এ কারণেই রোগের ভিত্তিমূলক কারণকে উৎপাটিত করে রোগ-প্রতিরোধ শক্তির উন্নতি ঘটানোই একজন হোমিওপ্যাথের লক্ষ্য। রোগের মূল কারণ যদি দূর করা হয়, তাহলে হয় রোগী আরোগ্য হবে অথবা দুর্ভোগগুলোর উপশম হয়ে আরোগ্যের দিকে অগ্রসর হবে। একটি রোগকে প্রতিরোধ করা, রোগীকে আরোগ্য করা অথবা তার কষ্টগুলো থেকে তাকে উপশম প্রদান করা- রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতারই এখতিয়ার। হোমিওপ্যাথিক ঔষধগুলো রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে প্রণোদিত করে। এ কারণেই প্রকৃতিকে তার ক্রিয়াকাণ্ডে কোন রকম ব্যাহত না করে এবং সিস্টেমিক ইমিউনিটির প্রায় কোনরকম ক্ষতি না করে- সমস্ত রোগের প্রতিরোধ, আরোগ্য বা উপশমে হোমিওপ্যাথি ব্যাপকভাবে সাফল্যমণ্ডিত। রোগী নিজেকেই নিজে চিকিৎসা করে; হোমিওপ্যাথি তার সেই আত্মরক্ষাকে সহায়তা করে। বোধহয় চিকিৎসাবিজ্ঞান জগতে এটাই হোমিওপ্যাথির স্বাতন্ত্র্য।
Discussion about this post