ডা. শাহীন মাহমুদ:
প্রাত্যাহিক জীবনে আমরা যত সাবধানেই কাজ করি না কেন, আঘাত আমরা পাই। সারা শরীরের যে কোন জায়গায় যে কোন সময় এই আঘাত পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, আর এজন্য প্রত্যেকটা মানুষেরই প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যাপারে সাধারণ জ্ঞান থাকাটা অত্যন্ত জরুরি। আজ যে লেখাটা আমি আপনাদের সামনে উপস্থাপন করতে চাচ্ছি, আঘাতের সাধারণ প্রাথমিক চিকিৎসার পরের ধাপ। অর্থাৎ, তাৎক্ষণিকভাবে কোন আঘাতে আপনারা কোন হোমিওপ্যাথিক ঔষধটা প্রয়োগ করতে পারেন, তার একটা প্রাথমিক ধারণা। অনেক সময়, আঘাত একদম সাধারণ মনে হলেও- খুব দ্রুত আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিটির মৃত্যুর কারণ হতে পারে। আবার এমন অনেক আঘাত আছে, যা তাৎক্ষণিকভাবে তেমন কোন প্রভাব বা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না করলেও- দীর্ঘদিন পরে তার জের দেখা যেতে পারে। যেমন- ঘাড়ে বা মাজার মেরুদন্ডে আঘাত, শরীরের কোন গুরুত্বপূর্ণ জয়েন্টে আঘাত। এমনকি এই আঘাত থেকে শুরু হতে পাওে দীর্ঘস্থায়ী কষ্টকর রোগের উপসর্গ। কিন্তুু সর্বক্ষেত্রেই যদি আঘাতের পরপরই সঠিক প্রাথমিক চিকিৎসার সাথে সাথে সঠিক ঔষধ সময়মত প্রয়োগ করা যায়, তবে এই উপসর্গগুলোর তাৎক্ষণিক ও বিলম্ব উপস্থিতি- দু’টো থেকেই মুক্তি পাওয়া সম্ভব। আর হ্যা, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা কখনোই রুটিনিজম বা স্পেসিফিকেশনকে সমর্থন করে না কিন্তু তার একমাত্র ব্যতিক্রম হচ্ছে এই আঘাত বা সে সমস্ত রোগ বাইরের কোন প্রভাবে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে সেগুলো। তবে এখানেও কিছুটা বিচার-বিবেচনার ক্ষেত্র থাকে। কাজেই, আঘাতের প্রাথমিক ক্ষেত্রে, সাধারণ মানুষের জন্য এর ব্যবহারিক দিকটা আমি সংক্ষেপে তুলে ধরছি। তবে, সবাইকে এটাও মনে রাখতে অনুরোধ করছি, প্রাথমিক সময়ে প্রয়োজনীয় ঔষধের নির্দেশনা ও পরামর্শ দিলেও, এটা অভিজ্ঞ চিকিৎসকের নিকট চিকিৎসার বিকল্প নয়। সঠিক সময়ে, সঠিক ঔষধ দিতে পারলে রোগের অনেক ভবিষ্যত জটিলতা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় বলেই, সচেতন ব্যক্তির জন্য এই সামান্য প্রয়াস।
প্রথমেই আমি আঘাতের ধরণ ও স্থান হিসেব করে তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ঔষধের পরামর্শ দিচ্ছি-
- থেঁতলানো আঘাত- আর্নিকা, বেলিস পার
- কোথাও ছেঁচড়ে বা ছিলে গেলে- ক্যালেন্ডুলা
- শরীরের নরম কোন টিস্যুতে আঘাত লাগলে (পেট, স্তন, অন্ডকোষ ইত্যাদি)- বেলিস পার
- ধারালো কিছুতে কেটে গেলে- স্টাফিসেগ্রিয়া
- মচকে গেলে- রাসটক্স, রুটা
- প্রচন্ড ঝাঁকি লাগার পর ঘাড়ে ব্যথা- হাইপেরিকাম
- হঠাৎ বসে পড়ে, ঝাঁকি লেগে, মেরুদন্ডের শেষ হাড়ে ব্যথা- হাইপেরিকাম
- জয়েন্টে বা সন্ধিস্থলে আঘাত- আর্নিকা, ব্রায়োনিয়া, আর্জেন্টাম মেটালিকাম
- নখে বা আঙ্গুলের প্রান্তগুলোতে আঘাত লাগলে- লিডাম, হাইপেরিকাম
- দাঁতে আঘাত লাগলে- আর্নিকা, হাইপেরিকাম
- চোখে আঘাত লাগলে- আর্নিকা, সিম্ফাইটাম
- হাড়ে আঘাত লেগে ব্যথায়- রুটা, সিম্ফাইটাম
- হাড়ের উপরের স্তরে এবং নরম হাড়ে আঘাত পেলে- রুটা, সিম্ফাইটাম
- কোন প্রাণীর কামড়ের পর- লিডাম, হাইপেরিকাম
- কোন পোকার কামড়ের পর- লিডাম, এপিস
এছাড়াও আঘাতের সাথে কিছু ভয়ানক অনুষঙ্গ সৃষ্টি হতে পারে, যেগুলোর ক্ষেত্রে দ্রুতগতিতে পদক্ষেপ নেয়াটা জরুরী হয়ে পড়ে। এরকম কিছু ক্ষেত্রের জন্য নিচের পরামর্শগুলোর কথা স্মরণ প্রয়োজন। এই সমস্ত ক্ষেত্রের ঔষধগুলো অন্তত: সবার হাতের কাছে থাকা উচিৎ। যেমন:
- মাথায় আঘাত লেগে বমি শুরু হলে- নেট্রাম সালফ
- মাথায় আঘাত লেগে স্মরণশক্তি বিঘ্নিত হলে- আর্নিকা, হাইপেরিকাম
- মাথায় আঘাত লেগে খিঁচুনি দেখা দিলে- আর্নিকা, সিকিউটা, কুপ্রাম মেট
- মাথায় আঘাত পেয়ে মাথা ঘোরানো দেখা দিলে- আর্নিকা, সিকিউটা, নেট্রাম সালফ
- মেরুদন্ডে আঘাত পেয়ে খিঁচুনি দেখা দিলে- জিঙ্ক
- আঘাতের পর মানসিক সমস্যা দেখা দিলে- আর্নিকা, নেট্রাম সালফ, সিকিউটা
এরপরও আঘাতের পর বেশ সময় নিয়ে কিছু কিছু সমস্যা দীর্ঘদিন চলতে থাকতে পারে। যেমন:
- কোথাও রক্ত জমে কালসিটে হয়ে থাকলে- আর্নিকা, বেলিস পার, লিডাম
- কোথাও আঘাতজনিত কারণে পুঁজ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে- ক্যালেন্ডুলা
- আঘাতের পর নাক দিয়ে রক্ত পড়ায়- আর্নিকা, ইলাপ্স, মিলেফোলিয়াম
- আঘাতের জায়গা ঠান্ডা হয়ে থাকলে- লিডাম
- অতিরিক্ত শ্রমজনিত কারণে শরীর ব্যথায়- আর্নিকা, রাসটক্স, ক্যালকেরিয়া কার্ব
- পুরোনো কারসিটে দূর করতে- সালফিউরিক এসিড, লিডাম
- ব্যথার জায়গা অবশ হয়ে থাকলে- আর্নিকা
এছাড়াও দৈনন্দিন ক্ষেত্রগুলোতে নিচের আঘাতগুলোর ব্যাপারেও শুরুতেই কার্যকরী ঔষধ দিতে পারলে, পরবর্তীতে আর জটিলতা বৃদ্ধি পাওয়ার অবকাশ থাকে না:
- ইঞ্জেকশনের ব্যথা কমাতে- লিডাম
- শক্ত বুটের চাপে ক্ষত হলে- পিউনিয়া
- লাম্বার পাংচার্ড করার পর- হাইপেরিকাম
- এক্স-রে এক্সপোজার হওয়ার পর- রেডিয়াম ব্রোম, এক্স-রে
এবার আঘাতের ক্ষেত্রে বহুলভাবে ব্যবহুত হয় সেরকম কিছু ঔষধের মূল লক্ষণগুলো বিবৃত করছি। রোগীর আঘাতের ধরণ, কারণ, স্থান বিবেচনা করে লক্ষণের সাথে মিলিয়ে ঔষধ দিতে পারলে, প্রায় যে কোন আঘাতের ভয়ংকর পরিণতি ও উপসর্গ থেকে বেরিয়ে আসার সম্ভব।
আর্নিকা: ঔষধটি আঘাতের ক্ষেত্রে প্রায় রুটিন প্রেসক্রিপশন হিসাবে দেয়া হয়। প্রায় সব ধরণের আঘাতের ব্যথায়- মচকে যাওয়া, পড়ে গিয়ে ব্যথা পাওয়া, থেতলে গিয়ে কালসিটে পড়ে থাকা সহ, সব ধরণের মেকানিক্যাল আঘাতের ক্ষেত্রে এটা ব্যবহৃত হয়। এটা আঘাতের স্থান হতে রক্তপাত বন্ধ করতে অত্যন্ত কার্যকরী, এবং ভবিষ্যতে পুঁজ হবার প্রবণতাকে রোধ করে। রোগীর আঘাতের পর প্রচন্ড থেঁতলানো বেদনা থাকে। ব্যথার স্থানে স্পর্শে সাংঘাতিক ভয় থাকে। মানসিক আঘাত বা শকের পর, বা অতিরিক্ত মানসিক শ্রমের পর মানুষের ভীড়ে (এগোরাফোবিয়া) সৃষ্টি হয়। সামান্য স্পর্শ, নড়াচড়া, ভেজা-ঠান্ডায় সমস্যা বৃদ্ধি পায়।
বেলিস পার: এটার মূল লক্ষণগুলো প্রায় আর্নিকার মতোই। তবে শরীরের গভীর টিস্যুগুলো আঘাতপ্রাপ্ত হলে, এটা বেশি কার্যকরী হয়। স্নায়ুতে আঘাত পাবার পর যদি অতিরিক্ত থেতলানো ব্যথা থাকে, যা ঠান্ডা পানির গোসলে অসহ্য হয়ে দাঁড়ায়- সেক্ষেত্রে এই ঔষধটি বেশি কার্যকরী হতে পারে। পেলভিসের প্রত্যঙ্গগুলোতে, মেরুদন্ডে- বিশেষ করে মেরুদন্ডের শেষ হাড়গুলোতে আঘাত পেলে এটা বেশি কার্যকরী। আঘাতের পরে টিউমার হলে এটা তা আরোগ্য করতে পারে। সাধারণত: সকালে ও ঠান্ডায় বৃদ্ধি পায়।
ক্যালেন্ডুলা: আঘাত লেগে ছিলে গেলে, ক্ষত হলে এবং তাতে রক্ত ও রক্তরস জমার প্রবণতা থাকলে এক্ষেত্রে ক্যালেন্ডুলা পুঁজ হবার প্রবণতা রোধ করে তা আরোগ্য করে। দাঁত তোলার পর রক্তপাত বন্ধে এটা চমৎকার কাজ করে।
সিকিউটা ভিরোসা: মূলত: এটা স্নায়ুর উপর কাজ করে। মাথায় বা মেরুদন্ডের আঘাতজনিত কারণে দাঁত লাগা, খিঁচুনি, স্মরণশক্তি হ্রাস ইত্যাদি ক্ষেত্রগুলোতে এটা অনন্য। একারণে এটাকে টিটেনাসের ঔষধ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। স্পর্শে, ঠান্ডা বাতাসে এবং ধূমপানে এর রোগী বৃদ্ধি পায়।
নেট্রাম সালফ: মাথার আঘাতের সর্বশ্রেষ্ঠ ঔষধ, বিশেষ করে মাথায় আঘাত সংক্রান্ত জটিলতায়, যেমন অন্ধত্ব, বধিরতা, মানসিক সমস্যাতে এটাই সর্বশ্রেষ্ঠ ঔষধ হিসাবে বিবেচিত হয়। এর রোগীর সমস্যা ভেজা, ঠান্ডা আবহাওয়ায় বৃদ্ধি পায় এবং শুকনো আবহাওয়ায় ভালো থাকে।
রুটা: হাড়ের উপরের আবরণে আঘাতের ক্ষেত্রে এটা অনন্য ঔষধ। হাতের ও পায়ের কব্জাতে আঘাত, মচকে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রথমেই এই ঔষধটিকে বিবেচনা করা হয়। আঘাতের পর হাতে গ্যাংলিয়ন সিস্টের ক্ষেত্রেও এটাকে রুটিন প্রেসক্রিপশন করা হয়। এর ব্যথা শুইলে এবং ভেজা ঠান্ডা আবহাওয়ায় বৃদ্ধি পায়। ব্যথার জায়গায় ডললে আরাম হয়।
রাসটক্স: অতিরিক্ত শারীরিক শ্রম, ভারী কিছু তোলা, বিশেষ করে উপরের কিছু ধরতে গিয়ে হাতে টান লেগে ব্যথায় ঔষধটি বিশেষ কার্যকরী। জয়েন্টের লিগামেন্টে এই ঔষধটি বিশেষভাবে কাজ করে। এর সমস্ত ব্যথা ঠান্ডায়, বৃষ্টিতে, আর্দ্রতাযুক্ত ঠান্ডা বাতাসে, বিশ্রামে ও বিশ্রামের পর প্রথম নড়াচড়ায় বৃদ্ধি পায় এবং গরমে, নড়াচড়ায়, পজিশন বদল করলে হ্রাস পায়।
সিম্ফাইটাম: এটা হাঁড়ের উপর এতটাই স্পেসিফিক কাজ করে যে, এটাকে অনেকে অর্থোপেডিক ঔষধ হিসাবে উল্লেখ করেন। চাপে, ধাক্কা লেগে, কোন কিছু ছুটে এসে লেগে, যে কোন ভাবে হাড়ে আঘাত লাগলে এটা কার্যকরী। হাড় ভাঙ্গলে, প্লাস্টার করার পর এটার প্রয়োগে হাড় দ্রুত জোড়া লাগে।
হাইপেরিকাম: স্নায়ুর আঘাতে সর্বশ্রেষ্ঠ ঔষধ হিসাবে বিবেচিত হয়। বিশেষ করে, মেরুদন্ডের স্নায়ু আঘাতপ্রাপ্ত হলে, মেরুদন্ডের শেষের হাড়ে ব্যথা পেলে এটা অত্যন্ত কার্যকরী। এছাড়াও যে সমস্ত স্থানে স্নায়ুর আধিক্য বেশি, যেমন- হাতের পা পায়ের আঙ্গুল, নখের মেট্রিস ইত্যাদি স্থানে আঘাত পেলে, এটা সর্বপ্রথম বিবেচ্য। এটাকেও টিটেনাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ঔষধ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ব্যথা, আঘাতের জায়গা থেকে উপরের দিকে ধাবিত হলে, বিশেষ করে মেরুদন্ডের দিকে গেলে এই ঔষধকেই বিবেচনা করতে হবে। সামান্য নড়াচড়ায়, স্পর্শে, ঠান্ডায়, স্যাতস্যাতে ও কুয়াশাময় আবহাওয়ায় রোগী বৃদ্ধি পায়।
লিডাম: ধারালো কোন কিছুর আঘাতে ক্ষত। ছিদ্র হওয়া ক্ষত। ক্ষতস্থান স্পর্শ করলে ঠান্ডা অনুভূত হয়। হাতের বা পায়ের কব্জায় মচকে যাওয়াতেও ব্যবহৃত হয়। এর আঘাতে ঠান্ডা পানিতে, এমনকি বরফ দিলে আরাম হয়। স্পোর্টস ইনজুরির ক্ষেত্রে এটাকে সর্বশ্রেষ্ঠ ঔষধ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ব্যথা রাত্রে ও বিছানার গরমে বাড়ে।
আঘাতের ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা অনন্য। কিন্তু সব ঔষধ আর সব ক্ষেত্র আসলে এখানে আলোচ্য নয়। এছাড়াও অনেক আঘাত আছে, যেগুলো ঘরোয়া প্রয়োগের ক্ষেত্রে নির্ভর করা ঝুঁকিজনক। কাজেই, সেগুলো আর উল্লেখ করলাম না। একটা কথা সবাইকে মনে রাখতে অনুরোধ করছি, বাসায় প্রাথমিকবাবে ঔষধ ব্যবহারের পরামর্শ থাকার মানে এই না, যে আপনাকে টিটেনাস ইঞ্জেকশন নিতে হবে না বা আনাড়ি হাতে নিজে খাওয়া ঔষধের উপর নির্ভর করেই বসে থাকবেন। এ ধরণের ঝুঁকি না নিয়ে, সাধারণভাবে আঘাতের ক্ষেত্রে সঠিকভাবে, হোমিও ঔষধের প্রয়োগ করতে পারলে যে কোন আঘাত থেকেই, অন্য যে কোন চিকিৎসা পদ্ধতির তুলনায়, দ্রুত, নির্ভরযোগ্য, সবচাইতে আরামদায়ক এবং কোন ধরণের পাশ্বপ্রতিক্রিয়াহীন ভাবে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
Discussion about this post