মানসিক রোগ আজ আর লজ্জার বা ভয়ের কোনো বিষয় নয়। সচেতন মানুষ মাত্রই জানেন যে, শরীর থাকলে শরীরের যেমন রোগ হয়, মনেরও তেমনই রোগ হতে পারে এবং সঠিক চিকিৎসা তা সম্পূর্ণভবে সেরেও যায়। অহেতুক ভয় বা ‘ফোবিয়া‘ কথাটির সাথে আমরা সকলেই কমবেশি পরিচিত। এর অর্থ ভয়। যদিও ‘ভয়’ মানুষের চরিত্রের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য কিন্তু যখন এই ‘ভয়’ মাত্রাতিরিক্ত আকার ধারণ করে অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি, কোনো নির্দিষ্ট বস্তু বা ব্যক্তি বা স্থান প্রভুতিতে কিংবা কোনো কাল্পনিক ঘটনাকে চিন্তা করে এতই ভীত হন যে, কল্পনাকে তিনি বাস্তবের সাথে আলাদা করতে পারেন না এবং এই অকারণ ভয় তার দৈনন্দিন কাজ কর্ম, জীবনযাত্রাকে একেবারে পর্যুদস্ত বা বিপর্যস্ত করে তোলে তখন কিন্তু সেটিকে আর স্বাভাবিক অবস্থা বলা যায় না। ফলে সেক্ষেত্রে এই ধরনের লক্ষণকে মানসিক অসুস্থতা হিসেবে বিবেচনা করাই উচিত। অনেকেই ব্যাপারটি অতটা গুরুত্ব না দিয়েই জীবন কাটাতে থাকেন। কিন্তু কালক্রমে এর প্রভাব বাড়তে থাকে এবং এমন জায়গায় পৌঁছায় যে পরবর্তীকালে রোগী গভীরভাবে ডিপ্রেশনে ভোগেন, সাথে থাকে অ্যাংসাইটি। যার ফলে তার পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার তৈরি হয়। তাই শুরু থেকেই এই ধরনের সমস্যার চিকিৎসা করা দরকার যাতে ভবিষ্যতে বড় সমস্যার মুখোমুখি না হতে হয়।
কারণ:
ছোটবেলায় কোনো মানসিক আঘাত বা গভীরভাবে ভয় পেয়ে থাকলে পরবর্তী জীবনে এই রোগ আসতে পারে। জোর করে কোনও কাজ করতে বাধ্য হলে বা অপছন্দের বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে থাকলেও মনের গভীরে অকারণে ফোবিয়া তৈরি হতে পারে।

- বংশগতভাবে এই ধরনের মানসিক রোগের ইতিহাস থাকলে।
- দীর্ঘদিন ধরে কোনও ক্রনিক রোগে ভুগলে ও মনের মধ্যে এক ধরনের ফোবিয়া তৈরি হয়।
- যারা অনৈতিক কাজকর্ম করেন, কিন্তু তা গোপন রাখেন বা রাখতে বাধ্য হন।
- একাধিক অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পরার কারণেও ফোবিয়া তৈরি হতে পারে।
- ড্রাগ বা মদ্যপানের অভ্যস থাকলে এই রোগ হতে পারে।
- জীবনের থেকে অত্যধিক চাহিদা থাকলে এবং তা পূরণ না হলে এই রোগ হতে পারে।
- আত্মবিশ্বাসের অভাব থেকেও ফোবিয়া তৈরি হতে পারে।
- সমাজের সাথে কিংবা অন্যের সাথে সম্পৃক্ত না হতে পেরে একাকিত্ব ভুগলেও ফোবিয়া তৈরি হতে পারে।
- বাবা-মা-এর মধ্যে বিচ্ছেদ বা অশান্তিজনিত কারণেও শিশুর মনে এই রোগের বীজ বপন হয়। শিশু ছোটবেলা থেকেই যদি অবহেলা, বঞ্চনা, অত্যাচারের মধ্যে দিয়ে বড় হয় এবং ভালোবাসা না পায় তা হলেও এই সমস্যা হতে পারে।
- প্রেমে হতাশা থেকেও ফোবিয়া আসতে পারে। এছাড়াও সিজোফ্রেনিয়া নামক মানসিক রোগেরও একটি অন্যতম প্রধান লক্ষণ হলো ফোবিয়া বা ভয়।

লক্ষণ:
বিভিন্ন ধরনের ফোবিয়ার ভিন্ন ভিন্ন লক্ষণ প্রকাশিত হয়। যেমন:-
- রোগী কোনো সামান্য ঘটনাকে নিজের মনের কল্পনার রঙ মিশিয়ে সেটি অত্যান্ত জটিল সমস্যা হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং সেটিকেই দৃড়ভাবে বিশ্বাস করে।
- রোগী কোনো একটি নির্দিষ্ট বস্তু, নির্দিষ্ট স্থান, নির্দিষ্ট ব্যক্তি কিংবা নির্দিষ্ট শব্দ দৃশ্য প্রভৃতিতে ভয় থাকতে পারে।
- রোগী এই ফোবিয়া থেকে রেহাই পাবার জন্য পলায়নমূলক মানসিকতা গ্রহণ করেন। ফলে তার সামাজিকতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রোগীর দৈনন্দিন জীবনযাপন চূড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।রোগীর স্মৃতিশক্তির উপর ভীষণভাবে প্রভাব পড়ে।
- যে সমস্ত রোগী চূড়ান্তভাবে ফোবিয়ার শিকার তারা অকারণে রেগে যান কিংবা অস্বাভাবিক আচরণ, দূর্ব্যবহার, খিটখিটে মেজাজ এবং আত্নহত্যা প্রবণ হয়ে ওঠেন।
করণীয়:
- কোনোরকম ভয়ের সিনেমা, গল্প, আলোচনা রোগীর সামনে না করা।
- বাড়ীর লোকের উচিত রোগীকে মানসিকভাবে সাহস দেওয়া এবং এই ধরনের অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করলে সচেতন হওয়া এবং প্রয়োজনে চিকিৎসা কাছে নিয়ে যাওয়া।
- রোগীর আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য ঘরোয়াভাবে সদর্থক পরামর্শ বা প্রয়োজনে সঠিকভাবে কাউন্সেলিং করানো।
- কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রোগী অকারণ ভয় পেলে তাকে সঠিক ও যুক্তিসম্মত কারণ ব্যাখ্যা করে রোগীর মনকে আশ্বস্ত করতে হবে।
- বাড়ির এবং চারপাশের পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা। রোগীর সাথে ভালো ব্যবহার করা, উত্তেজক পরিবেশ তৈরি না করা। অনেক সময় ছোট ট্যুর, মজা, ভালো খাওয়া-দাওয়ায় রোগীর মানসিক উন্নতি দ্রুত হয়।
ফোবিয়ার ইতিহাস
আসলে ভয় যখন মানসিক রোগের আকার নেয় তখন সেটিকে ডাক্তারি ভাষায় বলে ফোবিয়া নিউরোসিস। phobia শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ থেকে। phobia শব্দটি প্রথম ডাক্তারি পরিভাষায় যুক্ত হয়েছে প্রায় ২০০০ বছর আগে রোমে। যখন থেকে হাইড্রোফোবিয়া রোগের লক্ষণগুলিকে কুকুরে কামড়ানোর প্রধান লক্ষণ হিসেবে ধরা হতো। ১৮৭১ সালে ওয়েস্ট পল তিনজন মানষের উপর গবেষণা করে বর্ণনা করেন Agora Phobia রোগটিকে, এই রোগে আক্রান্ত মানুষেরা জনসমক্ষে বা জনবহুল স্থানে যেখানে অনেক মানুষের সম্মুখীন হতে হবে সেইখানে যেতে ভয় পান। ফলে তখন থেকেই বুঝতে শুরু হয় যে মাত্রাতিরিক্ত বা অকারণে ভয় কোনো সাধারণ সমস্যা নয়। এটি একটি মাসসিক রোগ। তবে অবশ্যই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিরাময়যোগ্য।
প্রকারভেদ:
Simple Phobia মূলত শৈশবে হতে পারে।
Social Phobia সদ্য প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে দেখা যায়।
Agora Phobia প্রধানত মধ্যবয়সের মানুষের বেশি হয়।

বিশেষ কয়েকটি ফোবিয়া
Cloustro Phobia দম বন্ধ হয়ে যাবার ভয়।
Acro Phobia উচ্চতাজনিত ভয়।
Zoo Phobia পশু থেকে ভয়।
Ophidio Phobia সাপের ভয়।
Xeno Phobia অত্যাশ্চর্যতাজনি ভয়।
Nyeto Phobia অন্ধকারজনিত ভয়।
Ergo Phobia কাজ করার ভয়।
Phobo Phobia ভয় পাবার আতঙ্ক।
Beleno Phobia সুচ ফোটার ভয়।
চিকিৎসা
হোমিওপ্যাথিতে অন্যান্য মানসিক রোগের মতো ফোবিয়া বা ভয়জনিত রোগের অত্যন্ত সুফল চিকিৎসা সম্ভব। বাড়ির লোক এবং চিকিৎসার সহযোগিতায় ধৈর্য্য ধরে চিকিৎসা করালে এবং কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চললে ফোবিয়া থেকে মুক্তি সম্ভব। তাছাড়া যেহেতু হোমিওপ্যাথি ঔষধ গ্রহণ করলেও অন্যান্য কোনও শারীরিক বা মানসিক জটিলতা আসার সম্ভাবনা একেবারেই থাকে না।